শেষ কোথায় (অন্তিম ও অসমাপ্ত পর্ব)

বাবা-মা ও অন্যদিকে অভিজ্ঞ থেরাপিস্টরা। কখনো বাবা-মায়েরাও থেরাপিস্ট হয়ে গিয়েছেন বাচ্চার কারনে। অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট পরবর্তীকালে বাবা-মা হয়েছেন এরকমটা খুব শোনা যায় না।
বাবা-মাকে কিন্তু রাত্রে শোয়ার আগের সময়টুকু অব্দিও অটিজমকে সঙ্গে নিয়েই থাকতে হয়। এমনকি দুটো অব্দি বিছানায় ছটফট করা অটিজম বাচ্চাটা বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে। থেরাপি সেন্টারে শিখে আসা কোন ফর্মুলায় তখন কাজে লাগে না। সকাল সন্ধ্যার প্রাথমিক নিজস্ব কাজকর্মগুলো পয়তাল্লিস মিনিটের সেশনে forward chaining , backward chaining মুখে বলে দেওয়া যায়, কিন্তু হাতে কলমে কাজ করতে গিয়ে নাকানি খেতে হয় সেই বাবা-মা কেই। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে যখন আর আরলি ইন্টারভেনশনের প্রয়োজন থাকে না, তখন নিরক্ষর, পরনির্ভরশীল ছেলেকে নিয়ে সেই মাকেই চোখের জল ফেলতে হয়। আমার সন্তানকে কে দেখবে?
"শেষ কোথায়" রচনাগুলিতে আমি এই বাবা-মায়ের শক্তিটাকেই পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছি। প্যারেন্ট সংস্থাগুলোর বীজটা বুনতে চেয়েছি।
আমরা বাবা-মায়েরা সবাই একই পালকেরই পাখি। একটু ঠোকাঠুকি তো লাগতেই পারে। তবু দিনের শেষে বেডরুমে শুয়ে আপনিও যে চিন্তা করেন, আর একজন বাবা বা মাও ঠিক সেই চিন্তাটাই করছেন।
আমাদের অনেক কিছুই করতে হবে। কিন্তু শুরুতেই সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেললে, হাঁপিয়ে যাবেন। সামনে থালা ভর্তি ভাত এবং পেটে অজস্র খিদে, গোগ্রাসে খেতে গিয়ে বিষম লেগে যেতে পারে। কিন্তু আমি একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, আপনি শেষ পর্যন্ত যেটা চাইছেন সেটাই হবে, আপনার ভাগ্য সাথ দিক বা না দিক, হস্তরেখায় এনজিও করা থাকুক বা না থাকুক। খুব ছোট ছোট করে ভাবুন, ছোট জায়গার মধ্যে ভাবুন। বাবামায়েদের মধ্যেও বহু রকমের মানুষ থাকেন। কারো শিক্ষাদীক্ষা বেশি, কারোর অর্থনৈতিক জোর বেশি, কেউ বা প্রভাবশালী, কারোর আবার কথা শুরু হলে শেষ হয় না। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। ভালো শ্রোতা হলেই চলতে পারবেন। কেউ সদস্য সক্রিয় হবেন, কেউবা আবার হবেন না। সক্রিয় সদস্য তার সক্রিয়তার বিনিময়ে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আশা করতে পারেন। উল্টো দিকে আবার নিষ্ক্রিয় সদস্য যেকোনো দিন সক্রিয় হয়ে যেতে পারেন। সকলকে নিয়ে চলার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সবার প্রতি শ্রদ্ধা।
প্রতিটা উদ্যোগের শুরুর দিকটা একটু নিষ্ফলাই হয়। এটাকে লকিং পিরিয়ড বলে। যেহেতু বেশ কয়েকজন বিচ্ছিন্ন, স্বাধীন মানুষ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে একত্রিত হচ্ছেন, সেখানে ব্যক্তিগত ইগো কাজ করতেই পারে। পিতামাতাদের ছোট ছোট সংগঠনগুলিও এর বাইরে নয়। এর পাশাপাশি আছে বাইরের আক্রমণ। রাস্তার ধারের ছোট্ট চারাগাছটির মত। বেড়া দিয়ে আগলে রাখতে হয় একজনকেই। আমি কি পাচ্ছি, কি পাবো, সেই চিন্তাটা শুরুর দিকে নাই বা করলেন। করলেই আপনার উদ্যোগের আয়ু ওই তিন বছরই।
পিতা-মাতার সংগঠনগুলিতে একটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মার মধ্যে একজন খুব সক্রিয় থাকেন আর একজন নিষ্ক্রিয় থাকেন। নিষ্ক্রিয় স্পাউসকে অংশগ্রহণ করানোটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বড় বড় চিন্তা করে শুরুর দিকে "ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে" ওই নিষ্ক্রিয় স্পাউসটি আপনাকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে।
সবাই ফল দেখতে চায়। বড় ফল একদিনে দেখানো যায় না। সেইজন্য ছোট ছোট ফলের আশা করে ওই ফলগুলোই দেখা ভালো।
সুতরাং বেঁচে থাকার এই গোষ্ঠীগুলোর কাজকর্ম শুরুর দিকেই হোক লক্ষ্যযুক্ত। ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করা। বাচ্চার না পারার জায়গাগুলি দেখে নিয়ে, সেইটাকে করতে পারার আনন্দ। প্রী এবং পোস্ট ভিডিওর কথা ভাবা যেতে পারে। তিন বছর বাদে গড়ে ওঠা কমিউনিটি লিভিং এর গুরুতর চিন্তা ভাবনা না নিয়ে তিন মাসের ছোট উদ্দেশ্য নিয়ে অটিজম মানুষটির একান্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো শেখানোর দিকে জোর দেওয়া যেতে পারে। যদি কোন লক্ষ্যকে আপনি উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবে আপনার মনোবল বাড়বে। ছোট কোন লক্ষ্য নিলে সেটা সম্ভব। প্রথম থেকেই বড় লক্ষ্যের দিকে ঝাপালে ধৈর্য হারিয়ে যায়।
অনেক বাবা-মায়ের অনেক হিডেন এজেন্ডা থাকতে পারে। প্রথম দিকের উদ্যোগে তা ধরা নাও পড়তে পারে। আবার সবচেয়ে কটুভাষী মানুষটি হয়তো সবচেয়ে সৎ ও দক্ষ সদস্য হতে পারেন। যতদিন যাবে ছাঁকনিতে গোটা চালটার মত হয়তো শুধু আপনাকেই থেকে যেতে হবে ছাঁকনির ওপারে। যারা চলে গেলেন তারা কিন্তু সবাই বেনিফিশিয়ারি হতে চাইবেন। কেউ ছেড়ে যাবেন না। ছাকনি উপরে দু-চারজন যে রয়ে গেলেন তারাই গোটা টিমটাকে নেতৃত্ব দেবেন। একদিন আসবে যেদিন সবটাই আপনাকে ভাবতে হবে। অথচ সেটা সবার জন্য।
প্রথমে মেমোরেন্ডাম তৈরি করা, বাই-ল তৈরি করা, তারপর প্রত্যেক সদস্যর আধার কার্ড, প্যান কার্ডের জেরক্স দিয়ে গত বছরের অডিট রিপোর্ট, অ্যানুয়াল রিপোর্ট বানিয়ে edistrict সাইটে গিয়ে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আপলোড করা। এইটুকুই প্রাথমিক কাজ।  প্রত্যেক কাজেরই একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। আবার নেট থেকে দেখে plagarism ও চলে। সরকারি অফিসগুলোতে সোসাইটি বা এনজিও করাটাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সুতরাং প্রতি পদে পদে বাধা, অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমার মতে, এই সোসাইটি রেজিস্ট্রেশনটুকু ও প্রতিবছর তার রিটার্ন বাদে, সরকারি অফিসে বেশি যাতায়াত না করাই ভালো। RPD রেজিস্ট্রেশন, 80G বা 12A রেজিস্ট্রেশন কোনটাই আপনার বাচ্চার developmental activity এর মধ্যে পড়ে না। বাচ্চার কিছুমাত্র উন্নয়ন হয় না। কেউ আপনার কাছে টাকার থলি নিয়ে ছুটে  আসে না। প্রথম তিন বছর নিজেরা একশ টাকা দিয়ে নব্বই টাকা খরচ করে শুধু প্রয়োজনীয় কাজকর্মটুকু করাই ভালো। বাচ্চাকে আত্মনির্ভর হতে গেলে বাচ্চার সোশ্যাল সিকিউরিটি জন্য তৈরি হওয়া বাবা-মাদের সংস্থাগুলোর আত্মনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। কেউ যদি আপনার জন্য টাকার থলি নিয়েও আসে, সে আপনাকে একবেলা খাবার যোগাবে। আবার পাঁচটা কথাও শোনাবে। আপনি যদি চল্লিশ হাজার টাকায় সংসার চালাতে পারেন, তবে সবার দেওয়া টাকায় চল্লিশ হাজার টাকার একটা সংস্থাও চালাতে পারবেন।
সুতরাং মোটকথা বাবা-মাকেই স্বাবলম্বী হতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে, অন্যের উপর নির্ভর না করে, সম্পূর্ণ তার সন্তানের জন্য। এতে আর কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। যদি একসঙ্গে থাকতে পারেন তবে আপনার শেষের দিনগুলো আনন্দের হবে। আফসোস হয়তো কিছুটা থাকবে, তবে আশা থাকবে তার থেকে অনেক বেশি। দেখবেন, কেমন করে নেগেটিভিটি কেটে গিয়ে সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছেন।

বাকি কাজগুলো করতে হবে এই আশা রেখেই রচনার নামকরনে "অসমাপ্ত" রেখে গেলাম।

Comments

Popular posts from this blog

Is autism spectrum disorder manageable through therapies, see the hopes

জিনবৈকল্যে বিষক্রিয়া (স্টেমসেল - দ্বিতীয় পর্ব)

শেষ কোথায়?