শেষ কোথায়?

সন্তানের প্রতিবন্ধকতা বুঝতে পারার পরে পিতা মাতার সবচেয়ে বড় চিন্তা যে আমার পর সন্তানকে কে দেখবে? বয়স যত বাড়ে নির্ভরশীলতা ততো বাড়ে। শেখানো ছোট ছোট কাজগুলো শিশু ভুলে যায়, উল্টে আমরাও হাতে হাতে সব কিছু করে দিয়ে তাকে আরো পরনির্ভরশীল করে তুলি।  চোদ্দ বছর বা তারও পরে আস্তে আস্তে যখন বুঝতে পারা যায় যে বাচ্চার পড়াশুনা সেইমতন এগোলো না, নিজের কাজগুলো ঠিকমতন নিজে করতে পারে না, দৈনন্দিন প্রাকৃতিক কাজেও আমাকে সাহায্য করতে হয়, তখন বাবা মায়ের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আমার পরে সন্তানকে কে দেখবে?
চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। বহু ইস্পাতকঠিন পিতা-মাতার অন্দরমহলের শিশুমনে আমি এই কষ্টটা দেখেছি। মেনে নেওয়া বা ছেড়ে দেওয়ার মানে এই নয়, আমি আমার সন্তানের ব্যক্তিগত জীবন, স্বীকৃতি, ভালো লাগাকে অস্বীকার করবো। পাখির মধ্যে সহজাত উড়বার প্রবৃত্তি থাকে, বাবা পাখির কাজ শুধু ধাক্কা দেওয়া।
আমার কিছু গুছানো চিন্তাভাবনা আছে। আপনাদের ভালো লাগলে আমরা এগোতে পারবো।
আত্মকেন্দ্রিক সন্তান পিতা-মাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ করেন। পিতা-মাতা হয়ে সন্তানের জন্য আশ্রমের খোঁজ করাকে, আত্মকেন্দ্রিকতা বলে কিনা জানি না। জেল, গারদ, বৃদ্ধাশ্রম, বৃন্দাবনের বিধবা নিবাস, ওয়ার্কিং মেস, নেশা ছাড়ার জন্য রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, পাগলা গারদ এরকম কিছু প্রতিষ্ঠানে আমরা সমগোত্রীয় মানুষদের একসাথে থাকতে দেখতে পাই। তাদের সংসার হয় না, সন্তান সন্ততি হয় না, পৃথিবীর আনন্দ, স্বাদ, আহ্লাদ তাদের জন্য নয়। বিয়েবাড়ি, অনুষ্ঠানবাড়িতে তাদের কোন নিমন্ত্রন নেই। শুধু জীবনটাকে কোনরকমে টেনে বয়ে নিয়ে যাওয়া। নিজের সন্তানদের এরকম পরিণতি ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। যতই assisted living কে বিজ্ঞাপিত করা হোক না কেন দিনের শেষে "সেও একটা হারিয়ে যাওয়া"।
অতীত থেকে শুরু করে বর্তমানেও প্রতিবন্ধী সন্তানদের জন্য এই একই ধরনের হোম বা আশ্রমের চিন্তাভাবনা হয়ে আসছে। সরকার অবশ্য হোম ম্যানেজমেন্ট কমিটিগুলির দিকে কড়া নজর রাখে। অডিট বা এক্টিভিটির ওপর সরকারি কন্ট্রোল নেই, একথা বলা যায় না। তাও অনেক ছোট ছোট ফাঁক থেকে যায়। বাথরুমের দরজার ভিতরে ছিটকানিটা বহুদিন ভাঙ্গা থেকে যায়। কমোডে চাপ দিলে জল পড়ে না। ঘরের কোনাতে জমানো ময়লা একইভাবে রয়ে যায়। যখন জানিয়ে-বলে ইনস্পেকশন আসে, তখন আচমকাই দু-একদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়। এই ভাবেই হয়ে আসছে। কিছু দরদী প্যারেন্ট ছাড়া বাচ্চাটার ঘরের মশারির হুক বহুদিন খুলে গেছে, এটা নজরে আসবে না। সঙ্গে সঙ্গেই হোয়াটসঅ্যাপ ফটো অথরিটির মোবাইলে পৌঁছাবে না। চল্লিশোর্ধ মানুষটির বহুদিন দাড়ি কাটা হয়নি, সেটাও কেউ তাকিয়ে দেখবে না। কারণ ওখানে দেখার লোক নেই। যে লোককে দেখবে বলে রাখা হয়েছে, তাকে তিন মাসে একবার কেটেকুটে বেতন দেয়া হয়। তারও কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, শুধু বিতৃষ্ণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর "মাইনে বাড়াও মাইনে বাড়াও"। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এরকম মানুষদের আত্মীয়-স্বজন, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, ভাই বোন কেউ কোন খোঁজ নেয় না। বিয়েবাড়ি, নেমন্তন্ন বাড়িতে ডাকে না।
পরনির্ভরশীলতার জন্যই তো হোমের খোঁজ করা হয়। এর সঙ্গে রয়েছে কিছুটা নিরাপত্তার আশ্বাস। Under-one-roof এর পিছনে ছুটতে গিয়ে এরকম assisted living এর চিন্তা করি। একটা বড় ফ্ল্যাট বানিয়ে নিজেদের মতো ফ্ল্যাটে থাকো, সবাই সবাইকে দেখভাল করো। বা একটা হোম বানিয়ে সেখানে ঘরে ঘরে গাদাগাদি করে দশ পনেরোটি মানুষকে রেখে দাও। এইরকম community living বা assisted living এর বাইরেও আমার কিছু চিন্তাভাবনা আছে। এর কোন নাম আমি দেইনি। যদি সত্যি কোন দিন হয় তবে আফসেই নাম লেগে যাবে।
ছোট্ট একটি শহর কল্যাণীকে নিয়ে চিন্তা করি। A block, B block মিলিয়ে লাখখানেক বাড়ি। তার শতকরা মাত্র এক শতাংশ বাড়িতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা থাকেন। তারা সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন, পরিবারের সঙ্গে থাকেন, বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্নরকম চিন্তাভাবনা, কেউ হয়তো একাত্ম করে নিয়েছেন, কেউবা আবার বোঝা মনে করেন। ছোট ছোট পরিবারের বয়স্ক মানুষেরা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছেন। ভাইবোনেদের নিজস্ব সংসার, স্ত্রী-স্বামী-সন্তান, তাদের পড়াশোনা, দায়িত্ব, চাকরি বাড়ছে। দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছেন। সামাজিক পরিচয় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে সন্তানসন্ততির বিবাহ আছে। যতটা সম্ভব জীবনের দুঃখের অংশটিকে ঢেকে-চেপে রাখতে হবে। বাবা-মায়ের উত্তরাধিকারের থেকে যেটুকু পাওয়ার কথা ছিল সেটুকু তো কবেই শূন্য হয়ে গেছে। চল্লিশোর্ধ মানুষগুলির নিজের লোকেরাই আজ ফ্রি হোমের খোঁজ করেন। প্রথমে suppression তারপর escape. এই ভাবেই চলে আসছে। আজ নিজের মানুষগুলোকেও দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। ঝেড়ে ফেলতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। শুধু দুবেলা দুমুঠো খাওয়া, একটু হাতের কাজ, জামাকাপড়, একটু পরিছন্নতা, সবার উপরে একটু ভালোবাসা, এছাড়া তোদের আর কোনো চাহিদা নেই। কিন্তু সেই মাথার ওপর ছাদটাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কারণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা তো কোনো অভিযোগ করতে পারেন না। যেটুকু চিৎকার-চেঁচামেচি হাইপেরাক্টিভিটি বলে, সেটাকে ঝামেলা বলে ঝেড়ে ফেললেই হলো।
আমার বক্তব্য হলো এই মানুষেরা আজ যেখানে আছে, কালও সেখানেই থাকবে।
একটা প্যারেন্ট-পরিচালিত সিন্ডিকেট থাকবে। তাতে নির্বাচিত সাতজন মানুষ থাকবে। এই সাতজন মানুষের পরের স্তরে অন্যান্য প্যারেন্টরা সাধারণ সদস্য হিসাবে থাকবে। এই সাতজন মানুষ, প্রতিটি সাধারণ সদস্যের নিকট দায়িত্ববদ্ধ ও প্রশ্নযোগ্য থাকবেন।
একটি জিমেইল একাউন্ট থাকবে যার পাসওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাত জনের কাছেই থাকবে। এই জিমেইল থেকে গুগল শীটের মাধ্যমে রোস্টার, সিডিউল ও অন্যান্য কিছু মেন্টেন করবেন সাত জন প্যারেন্ট এর একটি স্যালারিড এডমিন কমিটি। এডমিন কমিটিকে নজর রাখবে ম্যানেজমেন্ট কমিটি।
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো দুবেলা দুমুঠো খাওয়া। এই দুবেলা-দুমুঠো খেতে গিয়ে আমাদের বহু লোকের উপর নির্ভর করতে হয়। বাজার করা, রান্না করা, থালাবাসন ধোয়া, আরো কত কিছু। যদি ক্লোরেলা জাতীয় কোন খাবার খেয়ে আমাদের পেট ভরে যেত এবং সারাদিনে আর খিদে না পেত, ভেবে দেখুন তবে আমাদের activities of daily living অর্ধেক হয়ে যেত। এই দুবেলা খাওয়ার জন্যই যত ইনকাম, যত ঝগড়া, যত বাঁকা বাঁকা কথা।
যদি সকাল বিকেল এবং মাঝে একবার টিফিন জাতীয় খাবার আমাদের কেউ দিয়ে যেত, তবে এত পরিশ্রম করতে হতো না।
সিন্ডিকেটটির প্রধান এবং প্রথম কাজ হবে দিনে তিনবেলা এই তৈরি খাবার সরবরাহ করা। অনেকটা মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের মতো। অবশ্যই সেটা অ্যাপবেসড হবে। এবং তাকে সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত করবে প্যারেন্ট কমিটি ও কিছু কেয়ার গিভার। এই ব্যাপারে কোন বহিরাগত সংস্থার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
দ্বিতীয় স্তরে আসছে activity of daily living সংক্রান্ত কিছু কাজ ও তার monitoring। এই কথাটা আমাদের মানতেই হবে যে আমাদের সন্তানদের activity of daily living জাতীয় কাজকর্মে কিছু সমস্যা রয়েছে। ছোট বয়সে এবং মাঝবয়সে মা বাবারা যতটা করে দিয়ে এসেছেন, তার ওপর বাচ্চার activity of daily living এর দক্ষতা ও অদক্ষতা নির্ভর করে। প্রত্যেকটি মানুষের জন্য একজন বা দুজন করে কেয়ারগিভার নির্দিষ্ট থাকবেন। প্রত্যেকটি ঘরে অর্থাৎ যেখানে এই মানুষেরা থাকবেন, সেখানে ষোল থেকে কুড়িটা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকবে এবং সেই ক্যামেরার পোর্টালভিউ কন্ট্রোলরুম থেকে ডেক্সটপে এবং মোবাইলে যথাক্রমে ezviz ও IVMS সফটওয়্যার এর মাধ্যমে মনিটর করা হবে। এই কাজটি করবেন ম্যানেজমেন্ট কমিটির অধীনে সাতজন প্যারেন্টের একটি সাবকমিটি। এই সাব-কমিটির মনিটরিং রোস্টার ও পে স্কেল নির্দিষ্ট থাকবে।
Sheltered workshop বিষয়টির খুবই প্রয়োজন। দিনের এগারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত মূল সময়টায় এইরকম মানুষেরা যাতে কিছু সৃষ্টি করতে পারে, নতুন কিছু তৈরি করতে পারে, কোন কাঁচামালকে পাকা মালে রূপান্তরিত করতে পারে, তার জন্য sheltered workshop এর খুব প্রয়োজন। এইটা আমার চিন্তাভাবনার তৃতীয় পর্যায়। বিষয়টা দু রকম ভাবে চিন্তা করি। Individual entrepreneurship এর জন্য one isto one এ একজন নিউরোটিপিকাল মানুষের সঙ্গে স্পেশাল মানুষের জুটি করে আমাজন বা অন্যান্য ই-মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কিছু তৈরি সামগ্রী বিক্রি করা যায়। অন্য চিন্তাভাবনাটি group entrepreneurship. এইখানেও একইভাবে ই-মার্কেটিং এর উপর নির্ভর করতে হবে। যেকোনো শেল্টার ওয়ার্কশপ এর ক্ষেত্রেই যে ব্যাকরণটি মাথায় রাখতে হয়, তা হলো কাঁচামালকে পাকা মাল করতে হবে এবং প্রাকৃতিক বা পরিবেশবন্ধুসুলভ দ্রব্য সামগ্রীর দিকে নজর দেওয়া।
এবার আসি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার কথায়। উচ্চমানের না হলেও অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা প্রয়োজন, প্যারেন্ট পরিচালিত এই চিকিৎসা কেন্দ্রে কেয়ার গিভার ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অবশ্যই থাকবেন।
সুতরাং কেয়ারগিভারের প্রয়োজনীয়তাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িভিত্তিক দেখভাল করার জন্য, ওয়ার্কশপে কাজ করার জন্য, হসপিটালে নার্সিংএর জন্য কেয়ারগিভারের প্রয়োজনীয়তাটা খুবই প্রাথমিক। এই কেয়ারগিভারকে অতি অবশ্যই স্পেশাল বাচ্চাদের জন্য শিক্ষিত ও সহানুভূতিশীল হতে হবে।
এবার আসি টাকা-পয়সার রক্ষণাবেক্ষণ এর কথায়। বাবা মা সন্তানের জন্য যে পয়সা রেখে যাবেন বা অন্য কোন সহৃদয় ব্যক্তির কাছ থেকে যদি কর্পাস ফান্ড আসে, তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ট্রাস্ট এর অন্তর্ভুক্ত করে ওই নির্দিষ্ট অর্থ থেকে তার খরচ চালানো হবে। প্যারেন্ট পরিচালিত এই ট্রাস্টের সদস্য হিসাবে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবন্ধী মানুষেরা অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং ব্যাংক এই ট্রাস্টের fiduciary banking responsibility এর দায়িত্বে থাকবে। ব্যাংক safeguarding fund and meeting fiduciary requirements এর জন্য সম্পূর্ণ হবে দায়িত্বশীল থাকবে। কোন প্যারেন্ট, কেয়ারগিভার বা প্রতিবন্ধী মানুষদের ব্যাংকিং পার্ট এ কোন অথরিটি থাকবে না। কোনরকম কারেন্সি কোথাও ব্যবহার হবে না, অর্থাৎ ট্রাস্ট সম্পূর্ণভাবে zero cash mandate অনুসরণ করবে।
একটি ছোট শহর বা তার আশেপাশের দশ কিলোমিটারের মধ্যেকার অঞ্চলগুলিতে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ প্রতিবন্ধী মানুষকে দেখভাল করতে পারবে এই ট্রাস্ট বা সিন্ডিকেট বা কমিটিগুলি। এত বাধ্যবাধকতা সত্বেও কিছু দুর্বলতা তো থেকেই যাবে। সেটিকে কাটিয়ে তোলার জন্য প্যারেন্টরাই যথেষ্ট।
আমরা জানি না বা জানতেও চাইনা "ওলা- উবেরের" মালিক কে? তবু তার পৃথিবী জুড়ে কাস্টমার। যে ফেসবুকে আপনার সারা দিন কাটে, তাতে সমস্যা হলে আপনি তার মালিকের খোঁজ করেন না, ঠিক সেইরকম টেকনোলজি ও অ্যাপবেসড যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে, তাতে যদি টাকা-পয়সার ট্রান্সপারেন্সি থাকে, তবে বাকিটা সামলে নেওয়া যায়। তবু একটা ombudsman কমিটির প্রয়োজন আছে। যারা যেকোনো সমস্যায় সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন এবং সমস্যাগুলো অন্যান্যদের নজরে আনার চেষ্টা করবেন।

এতক্ষণ যে চিন্তাভাবনার কথাগুলো বললাম কিছুটা প্রাথমিক স্তরে চেষ্টা করেছি। এটাই দেখেছি যে technology অনেক transparency এনেছে, সেই transparency থেকে trust এসেছে এবং এই trust থেকে togetherness এসেছে। সবচেয়ে বড় সফল জায়গা zero cash mandate.

Comments

Popular posts from this blog

ছাকনি (আবার অটিজম!)

Is autism spectrum disorder manageable through therapies, see the hopes

আমার অটিস্টিক সন্তান কবে কথা বলবে?