চোরা বিষ

আগে বাড়ির সামনে কেউ ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে গেলে ভাবতাম কেউ একটা বড় বাঁদর, একটা ছোট বাঁদর নিয়ে যাচ্ছে। আজকাল আর বাঁদর নিয়ে যায় না। সস্তায় বানানো হাড়ি-পাতিল-বালতি বিক্রি করার জন্য সেই বাঁদরের ডুগডুগি বাজাতে হয়। পুরনো অভ্যাসমতো দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ঠকে যেতে হয়।
সামনের বাড়িটা দোতলা হয়ে যাওয়াতে আজকাল আর শীতের রোদ্দুর টাও আসে না। শীতকালে মুখ দিয়ে আগের সিগারেটের মতো ধোঁয়া বের হতো। দাঁতগুলো ঠকঠক করে কাঁপতো। এখন যেন পৃথিবীও বুঝে গেছে এখানকার বাসিন্দারা ঠিক কী চায়। এয়ার কন্ডিশন এর মত ঠিক তেরোতে তাপমাত্রা ধরে রেখেছে। ঠান্ডা কমবো কমবো করে কমেনা, বাড়তে চাইলেও পারে না।
ঠান্ডার মধ্যে নিঃশব্দে চলা টোটোগুলোর একটা অদ্ভূৎ শব্দ রয়েছে। যেন বেহালার একটা তারকে নির্দিষ্ট টানে বেঁধে ছড় দিয়ে ঘষে চলেছে। একইরকমের একই ভাবে। তেলে চলা গাড়ির ঘর ঘর আওয়াজের থেকে ভালো। একটু পুরনো হলেই গাড়ির আওয়াজের মধ্যে গিয়ার পরিবর্তনের এক - দুই - তিন - চার শব্দ, যেন মনে হয় নারকেল গাছে কেউ দড়ি বেঁধে উঠে চলেছে। কালো ধোঁয়ায় নাক মুখ জ্বলে যায়।
ঈশ্বর গুপ্ত সেতু দিকে যাওয়ার রাস্তার দু'পাশে গাছগুলো দাড়ি চাচার মত চেছে ফেলেছে। এত দিনের চেনা ভূগোলটাই কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। প্রতিটা গাছের সঙ্গে একটা আড় চোখে তাকানো ভাব ছিল। এক একটা গাছের এক একটা বিশেষত্ব ছিল। কোনটার ছাওয়া বেশি কোনটার কম। কোনটা হয়তো রাস্তার উপর উঠে এসে সাইনবোর্ড গুলোকে ঢেকে দিয়েছে।
আজকে তার আর কেউ নেই। তারা যে কোনোদিন কাটা পড়বে ভাবতেই পারেনি। কার্বন ডাই অক্সাইড ছড়ানো গাড়িগুলো তো আজ অক্সিজেন দেওয়া গাছের থেকেও প্রয়োজনীয়। দূর থেকে রাস্তাটা বাক ঘুরে চলে গেছে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু দিকে। গাছে ঢাকায় এপার ওপার যেটা দেখা যেত না, আজকে সবটাই ন্যাড়া। সূর্য ডুবলেই দূর থেকে ছুটে আসা জোড়া জোড়া আলোগুলো উন্নয়নের সিগনাল দেয়। আমার ছোট্ট একটা আলোর স্কুটি গাড়ি আর হয়তো এই রাস্তায় ছুটতে দেখা যাবে না। উন্নয়নে আমাদের মতন হামাগুড়ি দেওয়া লোকের ততটা জায়গা নেই। অফিস যাওয়ার আসার পথে যে পলাশ গাছটায় প্রতি বসন্তে লাল হয়ে যেত দেখতাম, এবার আর তাকে দেখতে পাবনা। গ্রামের মানুষরা গাছ কাটে না। হয়তোবা তারা অনুন্নতই থাকতে চায় । বীরভূমের রাস্তায় দুপাশ লাল আলো করা পলাশ বন দেখেছিলাম। বাস থেকে যতদূর চোখ যায়, একই রকমের লাল উঁচু নিচু হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। অংক কষে সৌন্দর্যায়ন করা যায় না। প্রকৃতি হয়তো সেখানেই থাকতে চায় যাদের এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।
মেয়ের ইস্কুলে যাওয়ার রাস্তায় একটা ঝাকড়া গাছ ছিল। মনে আছে এক বৃষ্টি ভেজা সকালে আমি আর আমার মেয়ে কোন রকমে গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচিয়েছিলাম। চৈত্র মাসের দুপুরে ওই গাছটারই নিচে দাঁড়ালে, কখন এক ঘন্টা সময় দশ মিনিটের মধ্যে কেটে যেত। একদিন দেখলাম গাছটা আর নেই। শুধু এক ফুট মত গুড়ি ছেড়ে রেখে গোটাটাই হারিয়ে গেছে। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব, কাকে নালিশ করব। গাছ বোধ হয় উন্নয়ন নয়, তাই ওর দাঁড়িয়ে থাকার অধিকার নেই।
রাত বাড়লে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ গুলো তালে তালে বাড়তে থাকে। শুনেছি ওরা নাকি ডানা নাড়ে। কোন আওয়াজ একই রকমভাবে, কোনোটা আবার বেসুরো। ভাগ্যিস ঝিঝি পোকা এখনো শামুকের মতো লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়নি। শামুকের তো একমাত্র নালার মধ্যে ঘুরে বেড়ানোই কাজ নয়, কোন সুন্দরীর মুখে snail facial করতেও ঘুরে বেড়াতে হয়।
আকাশ কিন্তু এখনো পরিবর্তন হয়নি। বিমানে ভ্রমণ করার সময় জানলা দিয়ে আমি মাটির দিকে তাকাই না, আকাশ দেখি, খুব কাছ থেকে। যত কিছু কাটাছেড়া তো এই মাটিটুকুকে ঘিরেই। আকাশে প্লাস্টিক থাকে না, টক্সিন তাড়া করে না। বিমানকেও অযথা হর্ন বাজাতে হয় না। দৃষ্টিপথে কোন অচেনা ভূগোলকে দেখতে হয় না। আকাশের কোন ভূগোল নেই।

আপনি-আমি পাঁচটা লোক এক জায়গায় হলে যেটা ফেলে যাই, সেটা প্লাস্টিক। সেই প্লাস্টিক গরু খায়, দুধ দেয়, সেই দুধ আমরা আবার প্লাস্টিকে ভরে খাই। আপনার আমার জন্য ভবিষ্যতের অ্যালজাইমার হয়তো তোলা থাকছে। 

Comments

Popular posts from this blog

ছাকনি (আবার অটিজম!)

Is autism spectrum disorder manageable through therapies, see the hopes

আমার অটিস্টিক সন্তান কবে কথা বলবে?