অটিজম সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা

অটিজম বা আত্নমগ্নতা একধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য যা শিশুদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এটি কোন রোগ বা মানসিক বিকার নয়। কিছু পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা, নিজের মতো করে থাকা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপনের ধারা এই অটিজম শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।
এটি একটি স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এবং বিভিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এক শিশু থেকে অন্য শিশুর মধ্যে অটিস্টিক আচার-আচরনে ফারাক থাকতে পারে। অটিজমের মাত্রা অনুযায়ী শিশুর পড়াশোনা ও জীবনযাত্রার প্রতিবন্ধকতা কমবেশি হতে পারে। মূলত দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শিশুদের এই অটিস্টিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। যে যে বৈশিষ্ট্য দেখা মাত্র একটি শিশুর মধ্যে অটিস্টিক আচরন আছে বলে মনে করা হয় সেগুলি হলো,
১) চোখে চোখে না তাকিয়ে কথা বলা।
২) খেলার জিনিস বাদে অদ্ভুত কিছু জিনিসে আসক্তি।
৩) শব্দ, গন্ধ বা আলো থেকে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
৪) নিজের মধ্যে ডুবে থাকা।
৫) অস্বাভাবিক চঞ্চলতা প্রকাশ করা।
৬) কিছু বিশেষ ধরনের একঘেয়েমি কাজকর্ম করা ইত্যাদি। অটিস্টিক শিশুর মধ্যে তিন ধরনের প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়।
১) কথা কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায় বা শেখানো শব্দগুলো হারিয়ে যায়।
২) অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে না, বাবা-মার আদরে সাড়া দেয় না, আনন্দ দুঃখের প্রকাশ থাকে না।
৩) আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়, একই ধরনের অদ্ভুত আচরণের প্রতি আসক্তি দেখা যায়, চঞ্চলতা প্রকাশ করে।
আলোচিত এই সব বৈশিষ্ট্য দুই বা তিন বছরের শিশুর মধ্যে দেখা গেলে অবশ্যই তাকে নিকটবর্তী শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে।
অটিজম এর কোন রকম ওষুধ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, তবুও রিসপেরিডন গোছের কিছু ওষুধ শিশুর হাইপারঅ্যাক্টিভিটি কমানোর জন্য দেওয়া হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া অবশ্য প্রয়োজন।
অটিজম এর সঙ্গে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও থাকতে পারে যেমন, ADHD, ডিস্লেক্সিয়া ডিসগ্রফিয়া, ডিস্ক্যালকুলিয়া, লার্নিং ডিসেবিলিটি ইত্যাদি। অটিজম মূলত একটি জিনগত সমস্যা এবং তাকে বাড়িয়ে তোলে পরিবেশের দূষণ। এই জিনগত ত্রুটি বা ব্যতিক্রম বাবা বা মা, যার কারো কাছ থেকে আসতে পারে। এক্স জাতীয় ক্রোমোজোমে এইরূপ ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
দূষণ অটিজমের এই বাড়বাড়ন্তের একটি কারণ। দূষণ মূলত শিশুখাদ্য এবং শিশুঔষধ থেকেই শিশুর দেহে প্রবেশ করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মনে করা হয় যে শিশুদের টিকা, মূলত এম-এম-আর ভ্যাকসিন অটিজম এর একটি অন্যতম কারণ। যদিও এই দাবি সম্পূর্ণ সত্য নয়।
এছাড়া অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য অপরীক্ষিত ওষুধ শিশুর দেহে এক থেকে দুবছরে অপরিমিত আকারে প্রবেশ করার জন্য জিনগত অটিজম বৈশিষ্ট্য পরিবেশগতভাবে আরও বাড়ছে।  এ ছাড়া শিশুখাদ্য, প্যাকেটজাত খাদ্য ও অন্যান্য প্রসেসিং খাবার অত্যধিক ব্যবহারের ফলে শিশুর শরীরের মধ্যে অনেক ধাতব মৌল একনাগাড়ে প্রবেশ করছে, যেটা অপরিণত ভাবে শোষিত হয়ে রক্তে মিশে যায়। এইসব দূষিত মৌল রক্ত থেকে ব্লাড-ব্রেন পথের মাধ্যমে যখন সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে মিশে যায়, তখন মস্তিষ্কের সেরিবেলাম, ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব ইত্যাদি অংশকে অকেজো করে তোলে। শিশু দিনে দিনে আরো বেশি অটিস্টিক হয়ে যায়। অটিজম বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে শিশু তার নিজের জগতে থাকতে চায়, খুব একটা বাইরের সঙ্গে মিশতে চায়না বা মানিয়ে নিতে পারে না। শব্দ এবং রঙের প্রতি ভীতি এবং বিতৃষ্ণা থাকে, বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে এবং খুব অল্প সময়ে নর্মাল পড়াশোনার বাইরে চলে আসে।
অটিস্টিক শিশুর আচরণের মধ্যে এতটাই অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় যে, তাকে নিয়ে পিতা-মাতা বিব্রতবোধ করেন। সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেলামেশা করতে পারেন না। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হয়। প্রতিবছর ২রা এপ্রিল অটিজম দিবস পালিত হয় এবং এই মুহূর্তে ভারতে প্রতি ঊনষাট জন নতুন বাচ্চার মধ্যে একজনের অটিস্টিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। ভারতবর্ষে মোট অটিস্টিক শিশু এবং কিশোরের সংখ্যা প্রায় পনেরো লক্ষ।
মিনিস্ট্রি অফ সোশাল জাস্টিস এর অধীন ডিজেবিলিটি দপ্তর এইসব অটিস্টিক শিশু ও কিশোরের জন্য এক লক্ষ টাকা নিরাময়ের প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা করেছে।
এই মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ট্রাস্ট ভারতবর্ষের অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা বিকাশে দেখভাল করে।
অটিস্টিক শিশুকে ঠিক মতো বড় করতে গেলে কতগুলো বিশেষ কথা মনে রাখতে হয়। অটিজম একটি সারা জীবনের সমস্যা এবং কোন ওষুধ দ্বারা এটা সারে না। বিভিন্ন ধরনের থেরাপি যেমন স্পিচথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, সেনসরি থেরাপির মাধ্যমে বাচ্চার জীবন যাত্রার মান উন্নত করা যায়। স্পেশাল এডুকেশন বা বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে অটিস্টিক বাচ্চার শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। National Institute of open schooling এর মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। Right to person with disability সংক্ষেপে RPWD আইন 2016 সালের ডিসেম্বর মাসে demonitisation এর তোলপারের মাঝেও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের চার পারসেন্ট সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্র-স্বীকৃত স্বাবলম্বন কার্ড দেওয়া শুরু হয়েছে, যেখানে কাজের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
একজন অটিস্টিক শিশুকে বড় করার জন্য বিশেষত দুটি দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। একটি হলো তার উদ্বেগহীন রুটিন জীবন ও দ্বিতীয়টি সাজানো পরিবেশ বা স্ট্রাকচার্ড এনভারমেন্ট।  প্রথম শিশুটি অটিস্টিক হলে একই পিতা মাতার দ্বিতীয় শিশুর অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা তেইশ শতাংশ। কখনো দেখা গেছে যে যমজ শিশুর মধ্যে একজনের অটিজম রয়েছে অন্যজনের নেই।
কতটা অটিজম বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেইটা পরিমাপের জন্য বর্তমানে ব্যবহার করা হয় Indian scale of Autism assessment. মনস্তত্ত্ববিদদের এই পরিমাপের ধারাটি কতগুলো প্রশ্ন-উত্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে চারটে বিশেষ দিক এর উপর জোর দেওয়া হয়।
১) শিশুর আচার-আচরণ।
২) শিশুর কথাবার্তা ও ভাব প্রকাশের বৈশিষ্ট্য।
৩) শব্দ বর্ণ-গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা।
৪) দৈনন্দিন কাজকর্মে পারদর্শিতা।
বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় বিষয় (reinforcer) দ্বারা শিশুর মনোযোগ ও একাগ্রতাকে আকর্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং শিশুকে সমাজের প্রয়োজনীয় করে গড়ে তোলা যায়। কিশোর অটিস্টিক মানুষের সঙ্গে "যদি-তবে" ধরনের ব্যবহার এবং উদ্বেগের উপশম করালে অনেক ভালো কাজ পাওয়া যায়।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে, ভারত সরকার স্বীকৃত ন্যাশনাল ট্রাস্ট স্কুলগুলিতে অটিজম শিশুদের পড়াশোনা ও অন্যান্য বিকাশের কাজ চলছে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শিয়ারকলে পনেরো একর জায়গার ওপর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও সোমানি গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ভারতের প্রথম শুধুমাত্র অটিজম শিশু,  কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পড়াশুনা, রিসার্চ, থেরাপি, থাকা-খাওয়া, কাজকর্ম ইত্যাদির ব্যবস্থা গঠনমূলক স্তরে রয়েছে। আশা করা যায় 2022 সালের মধ্যে এর সম্পূর্ণ রূপ সামনে আসবে।  এছাড়াও কিছু বিদ্যালয় যেমন ওয়েস্টবেঙ্গল অটিজম সোসাইটি, প্রদীপ সেন্টার ফর অটিজম ম্যানেজমেন্ট, কল্যাণী লাইফ ইনস্টিটিউট, মনোবিকাশ, নোবেল মিশন এরাও বিভিন্ন ধরনের থেরাপি ও শিক্ষামূলক কাজকর্ম করে থাকেন।

অটিজম সম্বন্ধে মানুষের জানার আগ্রহ এখন অনেক বেড়েছে এবং অটিজমের বিভিন্ন দিকের প্রচার এখন আলাদা মাত্রা পেয়েছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পিতা-মাতাকে বদলী ও পোস্টিং এর বিষয় বিশেষ আদেশনামা প্রকাশিত হয়েছে।  সবশেষে বলি অন্যান্য পরীক্ষামূলক চিকিৎসা যেমন স্টেমসেল, gyrosonic sound থেরাপি, রেইকি বা হোমিওপ্যাথিক, বায়োমেড মেডিসিন দ্বারা অটিজমকে দূর করা যায় না।  এর জন্য একনাগাড়ে কঠিন পরিশ্রম করা এবং লেগে থাকার প্রয়োজন হয়।

Comments

Popular posts from this blog

Is autism spectrum disorder manageable through therapies, see the hopes

জিনবৈকল্যে বিষক্রিয়া (স্টেমসেল - দ্বিতীয় পর্ব)

শেষ কোথায়?