জিনবৈকল্যে বিষক্রিয়া (স্টেমসেল - দ্বিতীয় পর্ব)

আমার ঘনিষ্ঠ ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে তাকে নিয়েই 2015 সালে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলাম স্টেমসেল সম্বন্ধে জানতে। মধ্য কলকাতার একজন অভিজ্ঞ দিদি আমায় বলেছিলেন "বেড়াতে যাচ্ছ যাও, মুম্বাই খুব ভালো শহর।" দক্ষিণ কলকাতার আরেক দিদি আমাকে প্রায় আধ ঘন্টা নিজের ভাইয়ের মতন বকাবকি করেছিলেন টেলিফোনে। তবু ঘটি-বাটি বেচে চাঁদের পাহাড় শঙ্করের মত মেয়েকে নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলাম।
কোমরের কাছে ত্রিকোণাকৃতি একটি হাড়ের ভিতর মজ্জা কোষ জমা থাকে। সব কোষের ওইটি আদি কোষ। মনো-নিউক্লিয়ার সেল। পেশীকোষ, রক্তকোষ বা মস্তিষ্কের নিউরনকোষের যে ভাগ থাকে এই আদিকোষে সেই রকম কার্য নির্দিষ্ট থাকে না। ভাবা হয় যে, যদি এই আদিকোষগুলিকে মস্তিষ্কের সেরিব্রোস্পাইনালফ্লুইডে চালান করা যায় তবে নতুন নিউরনকোষ এর জন্ম হবে, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মৃতপ্রায় অক্ষম কোষগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে তাদের বাঁচিয়ে তুলবে। টিপ করে বেলুন ফাটানোর মতো নয়, "জয় মা" বলে একটা বড় পাথর ছুড়ে মারলাম।
কিছু বেলুন ফাটল কিনা জানিনা, সেটা লাল না হলুদ বুঝলাম না। প্রগ্রেসিভ এমিশন টমোগ্রাফি রিপোর্টে মেয়ের সেরেবেলাম পার্ট এ নীল অংশটা দেখে ভেবেছিলাম, আমার ছ লক্ষ খরচা করা আট কোটি নতুন স্টেমসেল সব সবুজ করে দেবে।
চল্লিশের কোঠায় ভেবেছিলাম রিমলেস অটোমেটিক প্রগ্রেসিভ চশমার সঙ্গে একটা সুন্দর সুইফ্ট ডিজায়ার কিনব। সব টাকা বেরিয়ে গেল।
কোন উপকার পাইনি। যেটুকু উন্নতি হয়েছে পেট ভরে সকাল বিকেল থেরাপি করানোতে হয়েছে। বাপ এবং মেয়ে দুজনেরই বয়সটাওতো বাড়ছে।  আর PET CT Scan স্ক্যান করাইনি। দুই-দুইবার মুম্বাইয়ে স্টেম সেল করিয়ে, বহু ভালো ভালো কথা শুনে আজ সেই মধ্য কলকাতার অনাত্মীয় দিদিটার কথাই মনে হচ্ছে। "তোমাকে কষ্ট করে বলতে হবে যে উন্নতি হয়েছে।" শুধুমাত্র স্টেমসেল করিয়ে আমার মেয়ের যতটুকু উন্নতি আজ দেখতে পাচ্ছি, সেটা হয়েছে, এমন কথা বলা ধৃষ্টতা। গত তিন বছর সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টা যে একই নাগাড়ে থেরাপি চলছে, স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটররা যে লড়াই দিয়ে যাচ্ছেন, আমি বাবা হয়ে সন্ধ্যাবেলার তিন ঘন্টা শুধুমাত্র মেয়ের জন্যই তুলে রাখছি তাতেই বিশ থেকে উনিশ হয়েছে।  যারা আজ বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাচ্চাকে বিশ থেকে একে তুলতে চাইছেন, ম্যাজিক কিছু আশা করছেন, ঘরের পয়সা জলে দিয়ে স্টেমসেল করে আসছেন, স্টেমসেল চিকিৎসা করিয়ে উন্নতি হবে ধরে নিয়ে জীবনের প্রোগ্রামিং করেন, তাদের বলছি স্টেমসেল চিকিৎসা অটিজমের কোন উন্নতি করে না। স্টেম সেল করানোর পরে মানুষ অটিজম থেকে মুক্তি পায় না, নতুন করে স্বাভাবিক বাচ্চার মত স্কুলে ভর্তি হয়ে পরীক্ষার গণ্ডি পার হয় না। বাবা মাকে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটেডদের ফোন নাম্বার মোবাইল থেকে মুছে দিতে হয় না। যেটুকু উন্নতি হয় খুব কষ্ট করে বলতে হয়। ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে গেলে "বেশ কাজ হয়েছে" আর চিমটি কেটে মায়ের হাতের রক্ত বের করে দিলে "কোনো কাজ হয়নি" এই রকম চিকিৎসার দরকার কি?
All that glitters are not gold.

এই কথা টুক কথা বলতে আমি আমার মেয়ের স্টেম সেল চিকিৎসা করার পরে প্রায় তিন বছর সময় নিলাম।

Comments

Popular posts from this blog

Over involvement with Autism

Tab based education to the autistics

Twelve points post covid-19 solution measures to be taken for the persons with disabilities