অটিজমের অল্পবিদ্যা

কর্মজীবনের মধ্য লগ্নে পশ্চিমবঙ্গের আরো পশ্চিমে বীরভূম জেলার খয়রাশোল ব্লকে আধিকারিক এর ভূমিকাতে থাকাকালীন আমার নজর ছিল অটিজমের গ্রাম্য রূপটি দেখার। রুপুশপুর বা লোকপুর- বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েতের ই নিকটবর্তী শহর, হয় সিউড়ি অথবা রানিগঞ্জ। কোন আত্মীয়র বাড়িতে রাত্রিবাস করার সুযোগ না থাকলে যাওয়ার সাহস করা যায় না। এক-দেড়শ মানুষের বসবাস ছোট ছোট গ্রাম গুলোতে ফেলে রাখা ডাঙ্গা জমিই বেশি। মাইল এর পর মাইল, যত দূরে চোখ যায়। নতুন বিদ্যুতের খুঁটি আমাকে গর্বের সঙ্গে দেখানো হতো। অফিস সুলভ দাম্ভিকতার খোলস ছেড়ে শাল-পলাশ-মহুয়ার জঙ্গল পেরিয়ে "নিজ গৃহ নিজ ভূমি" তদন্তের সময় আমার নজর ছিল প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর দিকে। জেনেশুনেই "প্রতিবন্ধী" শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম পলিটিক্যাল পার্টির লোক বা সহকর্মীদের বোধগম্য করবার জন্য। "গ্রামে গ্রামে বার্তা রটে গেল" আধিকারিক বাড়িতে প্রতিবন্ধী থাকলেই খাতায় নাম তুলছেন। আমার নজর কিন্তু অটিজমের দিকেই।

দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রামগুলোতে অটিজম নামক "না বোঝা শব্দ" টা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারিনি। শেখার ছিল - গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে গেলে "সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন" লাগেনা। শুধু সরিয়ে রাখতে হয় conflict of interest। অটিজম সম্বন্ধে ন্যুনতম ধারনাটুকু না থাকায় অটিজম এখানে অপ্রতিবন্ধী গোষ্ঠীভুক্ত। ইংরেজিতে লেখা disability certificate কাঠালী হাঁসদার কাছে "টিকিট"। CWSN এর ভাঙ্গা বাড়িটা "সরকারি সুযোগ-সুবিধার জন্য খাতায় নাম তোলার অফিস"। বিদ্যালয় এখানে কাউকে "গার্জেন কল" করে না। ও পাড়ার জীবনের ছেলে পুলকবাবুর ছেলেকে পেন্সিলের খোঁচা দিলেই গার্জেন রা " রে রে" করে আসে না। পিছিয়ে পড়া শিবু মাহাতো পাড়ার আর পাঁচটা কাকুর সাথেই একশো দিনের কাজে যায়। বড়রা গ্রামের শরফুদ্দিন অনাবশ্যক হাসলেও হ্যাঁ করে কেউ তাকিয়ে থাকে না। একসঙ্গে সবাই মিলে শুক্রবারের নামাজ পড়ে। বিয়ে বাড়ির উঠোনে "মাথায় ঘুষি মারা" বছর পঁচিশের পল্টু আর পাঁচটা বন্ধুর সঙ্গেই একই সারিতে খেতে বসে। Social inclusion উপলব্ধি করাতে এখানে কোনো সেমিনার লাগে না। " ও আমাদের ছেলে" এই বোধটাই যথেষ্ঠ। এখানে হোম নেই, অটিজম সেন্টার নেই, স্পেশাল স্কুল নেই, থেরাপি সেন্টার নেই, অটিজমের নামে ব্যবসা নেই, আকাশ ছোঁয়া আকাঙ্খা নেই, বাবা মা এর উদ্বেগ নেই, অটিজমের জন্যে ডিভোর্স নেই - শুধু আছে "সবাই মিলে ভালো থাকার খুব সাধারণ ইচ্ছা"

নাকরাকন্দা গ্রামের বাপ মা মরা বছর পঁয়ত্রিশের পুষ্প সরেনের পিতার নামের জায়গায় চন্দ্রবিন্দু বসাতে হাত কেঁপে ওঠে। জ্যেষ্ঠদের "পুষ্প খুব লক্ষী মেয়ে" ব্যাখ্যায় অটিজমের চেনা ধারণা গুলিয়ে যায়। আরো দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। মাথা নিচু করে মাটির কুড়ে ঘরে ঢুকে আমার অটিজমের গ্রাম্য রূপ দেখার উৎসাহ কে পুষ্প ভালোভাবে নেয়নি। ভাগ্য ভালো যে জানতাম অটিজমের হাইপার অ্যাকটিভিটি ঠিক কোথায় বাড়ে। যিনি আমার সামনে এসে কুণ্ঠিত হলেন তিনি পুষ্পর দুরসম্পর্কের ও কেউ হন না। "শত পুত্রের পিতা" কে ধৃতরাষ্ট্র বলে, "শত পিতার পুত্রী" কে হয়তোবা এখানে "পুষ্প" বলে।

Comments

Popular posts from this blog

Over involvement with Autism

Twelve points post covid-19 solution measures to be taken for the persons with disabilities

Tab based education to the autistics